বিজ্ঞানের বর্তমান উৎকর্ষের সময়ে মহাকাশ প্রযুক্তি একটি অফুরন্ত সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত। প্রযুক্তি বিশ্লেষকগণ ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, আগামী দশকের মধ্যেই মহাকাশ বিজ্ঞান হয়ে উঠবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল নিয়ামক। মহাকাশ প্রযুক্তি বিকাশের প্রথম দিকে গবেষণার পাশাপাশি সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে বড় দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রতিযোগিতা শুরু হলেও তা এখন হয়ে উঠেছে অর্থনীতির একটি বড় সম্ভাবনার খাত, যা প্রযুক্তির ক্রম উন্নয়ন এ প্রয়োজনীয়তাকে আরো বেশি অপরিহার্য করে তুলছে। সম্প্রচার, যোগাযোগ, আবহাওয়া, জলবায়ু পরবির্তনসহ নানা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মহাকাশ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি সুরক্ষা ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানেরও বড় মাধ্যম। ফলে বিশ্বজুড়ে এখন মহাকাশবিজ্ঞান পরিণত হয়েছে মহাকাশ বাণিজ্যে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণার উন্নতি, রাষ্ট্রীয় গৌরব ও সম্মান অর্জন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব, মানুষের ভবিষৎ অস্তিত্ব নিশ্চিত করা এবং সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতার উন্নয়ন ইত্যাদি মহাকাশ প্রযুক্তি প্রসারে অগ্রণী ভুমিকা রেখে চলেছে।
মহাকাশ প্রযুক্তিতে আমাদের অবস্থানঃ
স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষণা কার্যক্রমের সূচনা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৮০ সালে মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতেই বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে আগাম দুর্যোগ সতর্কীকরণ ও ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহারের মানচিত্র প্রণয়ন, নদী ও উপকূলীয় এলাকা পর্যবেক্ষণ, আগাম ফসল পর্যবেক্ষণ, বন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ পর্যবেক্ষণ, বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ফলাফল বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে সরবরাহের মাধ্যমে স্পারসো জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতেই স্পারসো বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তির প্রয়োগ, বিশেষত: উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণা কাজ পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন জিও-ডিসিপ্লিনারি শাখায় স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত প্রয়োগের মাধ্যমে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্য পরিচালনার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা সত্তেও বর্তমানে বাংলাদেশের নিজস্ব কোন ভূ-পর্যবেক্ষণ/রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট নেই বা বিদেশী কোন স্যাটেলাইট হতে উপগ্রহ চিত্র ধারণ/গ্রহণের জন্য স্পারসোর নিজস্ব কোন সচল গ্রাউন্ড স্টেশন নেই। ফলে জরুরি দুর্যোগকালীন সময়ে বা জাতীয় প্রয়োজনে উপগ্রহ চিত্র প্রাপ্তির জন্য আমাদের বিদেশী কোন স্যাটেলাইট বা গ্রাউন্ড স্টেশনের উপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেক সময় জাতীয় স্বার্থের অনুকূল নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপগ্রহ চিত্র সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না।
এছাড়া, বাংলাদেশে মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে কোন সুযোগ সেভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। এর ফলে দেশে কোন মহাকাশ প্রযুক্তির অবকাঠামো, যেমন নিজস্ব স্যাটেলাইট ও গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ, পরিচালনা এবং উন্নয়ন, মহাকাশ প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাগার স্থাপন ইত্যাদির কোনটিই গড়ে উঠেনি। ফলত: স্পারসো একটি সত্যিকারের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহ এরই মধ্যে মহাকাশ প্রযুক্তির নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনের পথে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়েছে, নিজস্ব পদ্ধতিতে স্যাটেলাইটের উন্নয়ন ও এ খাতে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করেছে। ভারত মহাকাশ প্রযুক্তির সক্ষমতায় বিশ্বের অগ্রগামী দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহের মধ্যে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের নিজস্ব ভূ-পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট রয়েছে।
মহাকাশ অর্থনীতি এবং সম্ভাবনাঃ
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, আগামীতে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ এবং এর প্রবৃদ্ধি হবে মহাকাশ প্রযুক্তি নির্ভর। উপগ্রহ প্রযুক্তি এবং মহাকাশ অনুসন্ধান আগামী বছরগুলিতে টেকসই বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার মূল চাবিকাঠি হতে পারে। নাসা (NASA)-র ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে মহাকাশ প্রোগ্রামে বিনিয়োগকৃত প্রতিটি ডলারের জন্য ৮ ডলারের অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করে থাকে। এছাড়া, লন্ডন ইকোনোমিক্স (২০১৯) এর একটি স্বতন্ত্র গবেষণায় দেখা যায় যে, European Space Agency (ESA) এর কার্যক্রমের অধীন ইংল্যান্ডে প্রতি পাউন্ড বিনিয়োগের বিপরীতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অর্থনীতিতে ১০ পাউন্ডের সুবিধা প্রাপ্ত হয়। এতে দেখা যায় যে, মহাকাশ কার্যক্রমে বিনিয়োগকৃত অর্থ সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে কয়েক গুণ হয়ে ফিরে আসে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মহাকাশ খাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে। উদ্ভাবন ও অর্থনীতির নতুন একটি বৃহৎ উৎস হওয়ায় এ খাতে উদ্যোক্তাদের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবনে মহাকাশ গবেষণা এখন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেটের উন্নয়ন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ব্যয় কমে যাওয়া, প্রযুক্তির অভাবিত অগ্রগতি প্রভৃতির কারণে মহাকাশ শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। Morgan Stanley (American Multinational Investment Bank) কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মহাকাশ অর্থনীতির বর্তমান আকার ৩৬০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৪০ সালের শেষ নাগাদ মহাকাশ অর্থনীতির আকার হবে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার। এছাড়া, Satellite Industry Association (SIA) এর ২০২১ সালে প্রকাশিত পূর্বাভাস অনুসারে ২০৪১ সালে মহাকাশ অর্থনীতির আকার হবে ১.০৫৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
সম্ভাবনাময় মহাকাশ শিল্প বিকাশে আমাদের পরিকল্পনা:
‘রূপকল্প ২০৪১’ উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনায় একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে হলে আমাদের এই সম্ভাবনাময় মহাকাশ শিল্পের অংশীদার হওয়া প্রয়োজন। এ বিপুল আয়ের অংশীদারীত্ব পেতে হলে এখনই প্রস্তুতির প্রকৃত সময়। এ খাতে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য আমাদের দক্ষ মানবসস্পদ সৃষ্টি এবং মহাকাশ প্রযুক্তি ও বিভিন্ন মূল্য সংযোজিত সেবার শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা দরকার। বাংলাদেশের বর্তমান জনমিতিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এ খাতে দক্ষ ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন জনবল গড়ে তোলার মাধ্যমে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। এজন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী জাতীয় মহাকাশ প্রতিষ্ঠান (National Space Agency) । একটি শক্তিশালী জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। স্পারসোকে একটি শক্তিশালী ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও সক্ষম সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে আমরা এ অগ্রযাত্রায় অংশ গ্রহণ করতে পারি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর আলোকে, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) মহাকাশ অবকাঠামো ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনাগুলির মধ্যে স্বল্প মেয়াদি (২০২০-২০২৪) উন্নয়ন পরিকল্পনায় রয়েছে জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন ও পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন, স্যাটেলাইটের উন্নয়ন-উৎক্ষেপণ এবং এআইটি ল্যাব স্থাপনের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিচালনা। এছাড়া, মহাকাশ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য সমন্বিত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, উপগ্রহের উন্নয়নের জন্য অ্যাসেম্বলি, ইন্টিগ্রেশন এবং টেস্ট (এআইটি) ল্যাব স্থাপন, ভূ-পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ইত্যাদি রয়েছে মধ্য মেয়াদি (২০২২-২০৩০) উন্নয়ন পরিকল্পনায়। আগামী ২০২৫-২০৪১ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় রয়েছে উন্নত গবেষণার জন্য আইকনিক স্পেস সায়েন্স ভবন নির্মাণ, নিজস্ব প্রযুক্তিতে উপগ্রহের উন্নয়ন ও উৎক্ষেপণ, মহাকাশ অর্থনীতি বিকাশের জন্য শিল্প পার্ক স্থাপন এবং মহাকাশ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন কেন্দ্র স্থাপন ।
পরিকল্পনাসমুহের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি, সাশ্রয়ী এবং টেকসই জাতীয় মহাকাশ কর্মসূচির সূচনা হবে যা বাংলাদেশে উপগ্রহ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রয়োগে উৎকর্ষতা অর্জন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতার উন্নয়ন ও সামর্থ্য প্রকাশের অন্যতম প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হবে। মহাকাশ প্রযুক্তির উন্নয়ন দেশের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসাবে কাজ করবে। একটি টেকসই মহাকাশ কার্যক্রমের মাধ্যমে ভবিষ্যতে মহাকাশ প্রযুক্তির জাতীয় ‘ফোকাল পয়েন্ট’ হিসাবে স্পারসোকে সঠিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে ‘সেণ্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসাবে গড়ে তোলা হলে তা দেশের প্রযুক্তিগত সামর্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনগণের জন্য টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখেবে। সর্বোপরি, মহাকাশ প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণা, উন্নয়ন, প্রয়োগ ও প্রশিক্ষণ, বিশেষত স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নয়ন হলে বর্হিবিশ্বে তা বাংলাদেশকে একটি একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যার দ্বারা আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
১। মিজানুর রহমান, চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব), বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)
২। মোঃ নূর হোছাইন শরীফি, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের লিংক: দৈনিক আমার সংবাদ, দৈনিক আমাদের নতুন সময় পৃষ্ঠা ৫, সমকাল, কালের কন্ঠ, আমাদের সময়